ডেস্ক রিপোর্ট | bangla.quickpost.news
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৭ জুলাই এক আনুষ্ঠানিক চিঠিতে জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাবতীয় পণ্যের ওপর ৩৫% শুল্ক আরোপ করা হবে। এই সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রপ্তানি খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
কী বলা হয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চিঠিতে?
ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউজ থেকে প্রকাশিত চিঠিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর চিঠির মূল বক্তব্যগুলো হলো:
বহু বছরের বাণিজ্য ঘাটতি:
ট্রাম্প লিখেছেন, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়িয়ে চলেছে। এ ঘাটতি এতটাই প্রকট যে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি:
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এই ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য:
ট্রাম্পের বক্তব্য, বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও ‘ন্যায্য, ভারসাম্যপূর্ণ এবং টেকসই’ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এই শুল্ক আরোপ করছে। তাঁর মতে, এটি ছাড়া উভয় দেশের জন্য স্বাস্থ্যকর বাণিজ্য সম্ভব নয়।
নতুন শুল্কহার:
তিনি ঘোষণা করেছেন, আগামী ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের সব রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫% শুল্ক আরোপ করা হবে। এই শুল্ক কোনো নির্দিষ্ট খাত বা পণ্যের জন্য নয়, বরং সব পণ্যের ওপর সমানভাবে কার্যকর হবে।
ট্রানশিপমেন্ট এড়াতে কড়া নজরদারি:
চিঠিতে বলা হয়েছে, কোনো পণ্য যদি অন্য কোনো দেশের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তাহলে সেই পণ্যের ওপর আরও বেশি শুল্ক আরোপ করা হবে।
শুল্কবৃদ্ধির শর্ত:
ট্রাম্প সাফ জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যদি পাল্টা শুল্ক বাড়ানো হয়, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রও শুল্কের হার আরও বাড়াবে। অর্থাৎ শুল্ক নিয়ে কোনও সমঝোতা না হলে উভয়পক্ষের শুল্ক বাড়তেই থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদনকারীদের জন্য ছাড়:
যেসব বাংলাদেশি কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাত করবে, তাদের ওপর এই ৩৫% শুল্ক প্রযোজ্য হবে না। এর মাধ্যমে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
শুল্ক পুনর্বিবেচনার শর্ত:
ট্রাম্প স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, বাংলাদেশের বাজার যদি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানির জন্য উন্মুক্ত হয় এবং শুল্ক ও অ-শুল্ক বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে এই শুল্কের হার ভবিষ্যতে পরিবর্তন বা কমানোর বিষয় বিবেচনা করা হবে। তবে সেটা বাংলাদেশের নীতি-পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করবে।
শেষ অংশে ট্রাম্প উল্লেখ করেন, “আপনার দেশের জন্য মার্কিন বাজার বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুযোগ। এই সম্পর্ক ন্যায্য হলে বাংলাদেশের মানুষও উপকৃত হবে।
বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে কী প্রভাব পড়বে?
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি বাজার। প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলারের পণ্য বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যায়। নতুন ৩৫% শুল্ক কার্যকর হলে এর বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
রপ্তানির বড় অংশ গার্মেন্টস ও হোম টেক্সটাইল:
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৯.৭৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে ৮০% এর বেশি রপ্তানি এসেছে পোশাক শিল্প থেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গার্মেন্টস পণ্যের ওপর সরাসরি এই শুল্ক আরোপের ফলে দাম অন্তত ৩০-৩৫% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা যারা মূলত সাশ্রয়ী দামের জন্য বাংলাদেশি পোশাক কিনে থাকেন, তারা এই বাড়তি দামের কারণে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া বা মেক্সিকোর মতো বিকল্প সরবরাহকারীর দিকে ঝুঁকতে পারেন।
চামড়া ও চিংড়ির বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব:
বাংলাদেশের চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও চিংড়ির রপ্তানিও যুক্তরাষ্ট্রে বড় অংশ জোগান দেয়। এই খাতগুলির উদ্যোক্তারা বলছেন, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপে তাদের মুনাফা কমে যাবে, কারণ এই খাতের প্রতিযোগিতা ইতিমধ্যেই কঠিন। দাম বাড়লে মার্কিন আমদানিকারকরা সরবরাহকারি বদল করতে দ্বিধা করবেন না।
ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি:
বিশাল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কিছুটা শুল্কের ধাক্কা সামলাতে পারলেও ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এই কারণে বহু প্রতিষ্ঠান নতুন অর্ডার হারানোর শঙ্কায় পড়বে। অনেকে তাদের উৎপাদন কমিয়ে দিতে বা শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হতে পারেন।
মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব:
বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন, নতুন শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশের পোশাক ও অন্যান্য পণ্যের দাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রায় ৩০-৪০% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এতে চাহিদা হ্রাস হবে এবং রপ্তানির পরিমাণ কমে যাবে।
বিজিএমইএ-এর উদ্বেগ:
বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, শুল্ক বৃদ্ধির ফলে অনেক কারখানা তাদের যুক্তরাষ্ট্রের অর্ডার হারাতে পারে।
বিজিএমইএ এর একজন পরিচালক বলেন:
“আমাদের ক্রেতারা ইতিমধ্যে নতুন চুক্তি স্বাক্ষরে দ্বিধা প্রকাশ করছেন। বাড়তি শুল্কে তারা অন্য দেশকে প্রাধান্য দিতে পারে।”
রপ্তানিকারকদের প্রতিক্রিয়া:
ঢাকার একজন পোশাক রপ্তানিকারক বলেন:
“এই শুল্ক আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। ইউরোপের বাজারও চাপে আছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হারালে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।”
বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য প্রভাব:
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই শুল্কের কারণে:
- রপ্তানি আয় হ্রাস পাবে।
- রপ্তানি-নির্ভর শিল্পে বেকারত্ব বাড়বে।
- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ তৈরি হবে।
- ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ পরিশোধে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
পণ্য বহুমুখীকরণের প্রয়োজন:
বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে শুধু গার্মেন্টসের ওপর নির্ভর না করে কৃষিপণ্য, আইটি সার্ভিস, ওষুধ এবং হস্তশিল্পসহ নতুন পণ্য খাত রপ্তানিতে মনোযোগ দিতে হবে।
সরকারের অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তৎপরতা শুরু হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া:
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন:
“আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ করছি। শুল্কের এই সিদ্ধান্ত আমাদের অর্থনীতির ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। তাই মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ স্থায়ীভাবে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাণিজ্য প্রতিনিধি, বাংলাদেশ দূতাবাস ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংগঠনের মাধ্যমে শুল্ক কমানোর প্রচেষ্টা চালাবে।
ট্যারিফ কমিশনের অবস্থান:
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক সিনিয়র সদস্য বলেন:
“প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণার আগে আমরা আনুষ্ঠানিক কোনো আগাম নোটিশ পাইনি। এখন আমরা দ্রুত সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করছি এবং প্রতিরোধমূলক কৌশল তৈরি করছি।”
এই কমিশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে যৌথভাবে শুল্কের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষণী প্রতিবেদন তৈরি করছে, যা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ:
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সাথে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও এক বিবৃতিতে বলেছেন,
“আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে সমস্যার সমাধান খুঁজছি।”
ব্যবসায়ীদের করণীয়
বিশেষজ্ঞ এবং রপ্তানিকারক নেতৃবৃন্দ মনে করছেন, উদ্যোক্তাদের এখনই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বিবেচনা করতে হবে:
মার্কিন ক্রেতাদের সাথে সরাসরি সমঝোতার চেষ্টা:
চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো, মূল্যছাড় বা বিশেষ ডেলিভারি শর্তে ছাড়ের প্রস্তাবের মাধ্যমে অর্ডার ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
শুল্ক সহনীয় পর্যায়ে আনার জন্য যৌথ লবিং:
বিজিএমইএ, ইপিবি, ফোরাম অব এক্সপোর্টার্সসহ বিভিন্ন সংগঠনকে যৌথভাবে মার্কিন বাণিজ্য সংস্থাগুলোর কাছে লবিং জোরদার করতে হবে।
উৎপাদন খরচ কমানো:
বিদ্যুৎ, পরিবহন ও কাঁচামালের খরচ কমাতে দ্রুত পরিকল্পনা দরকার, যাতে দাম তুলনামূলক প্রতিযোগিতামূলক রাখা যায়।
বিকল্প বাজারে প্রবেশ:
কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে রপ্তানি বাড়াতে উদ্যোগ বাড়ানো জরুরি।
সরকারি প্রণোদনা ও ভর্তুকির দাবি:
শুল্কের প্রভাব মোকাবিলায় সরকারিভাবে নগদ প্রণোদনা বা ভর্তুকির একটি প্যাকেজ দাবি করা প্রয়োজন। এতে উদ্যোক্তাদের ক্ষতি কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।
ভবিষ্যতের বাণিজ্য সম্পর্ক
চিঠিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর যেসব শুল্ক ও অ-শুল্ক প্রতিবন্ধকতা আছে, সেগুলো কমালে এই ৩৫% শুল্কের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।
ভবিষ্যতের নির্ভরশীলতা:
তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই শুল্কের ভবিষ্যত কয়েকটি বিষয়ে নির্ভর করবে:
- আগামী কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
- ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্য নীতি স্থায়ী হবে কিনা
- বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক কতটা স্থিতিশীল থাকে
- বাংলাদেশ সরকার কত দ্রুত ও কার্যকরভাবে সমঝোতার প্রচেষ্টা চালায়
ঢাকার একজন অর্থনীতিবিদ বলেন:
“যদি বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিকভাবে দ্রুত ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে রপ্তানি খাত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে। এই ক্ষতি পোষাতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।”
আশার আলোকরেখা:
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের শ্রমঘন খাতকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র উন্নয়ন সহযোগিতায় পাশে থেকেছে। তাই সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের সম্ভাবনা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি।