কুইকপোস্ট নিউজ | ১৮ মার্চ ২০২৫ | ঢাকা

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমীর ডা. শফিকুর রহমান সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেছেন, “দেশটা স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।” তার এই মন্তব্য নিয়ে দেশব্যাপী বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সত্যতা ও চেতনাকে পুনরায় প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টা হিসেবে অনেকেই একে দেখছেন।

ডা. শফিকুর রহমান মূলত বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন এবং দাবি করেন যে, স্বাধীনতার মাধ্যমে যে ন্যায়বিচার, সমতা ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে এই মন্তব্য করায় সমালোচকরা বলছেন, এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল, যা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে ধোঁয়াশার মধ্যে ফেলার চেষ্টা।

জামাত-ই-ইসলামি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে আল-বদর, রাজাকার ও শান্তি কমিটির মতো সহযোগী সংগঠন গঠন করেছিল। এই সংগঠনগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের দমন, বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং গণহত্যার জন্য দায়ী ছিল। EFSAS: Jamaat-e-Islami in Bangladesh: Past, Present and Future অনুসারে, জামাত মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিল। Wikipedia: Bangladesh Jamaat-e-Islami এবং Business Today: Understanding Jamaat-e-Islami এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

জামাত তার অতীতের ভূমিকা পুনর্লিখনের চেষ্টা করছে এবং দাবি করছে যে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই করেছিল, যা ইতিহাসের বিপরীত। শিবিরের ম্যাগাজিনে সর্বহারা এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা মিথ্যা ও ইতিহাস বিকৃত করার একটি প্রচেষ্টা। The Diplomat অনুসারে, এই দলগুলো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, যা জামাতের দাবির বিপরীত।

শিবিরের ম্যাগাজিনের এক প্রবন্ধে দাবি করা হয়েছে যে, “বাংলাদেশের মুসলমানরা না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল এবং এটি তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল।” এই বক্তব্য মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননাকর এবং স্বাধীনতাবিরোধী প্রপাগান্ডার অংশ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সমালোচকরা বলছেন, এটি ইতিহাস বিকৃতির একটি সুস্পষ্ট চেষ্টা, যা তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে ব্যবহৃত হচ্ছে।

জামাত-ই-ইসলামি কখনোই তাদের ১৯৭১ সালের কর্মকাণ্ডের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। বরং তারা বরাবরই মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন এড়িয়ে চলেছে এবং রাজনৈতিকভাবে নিজেদের অবস্থান রক্ষা করার চেষ্টা করছে। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামাত নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করা হলেও, দলটি এখনো তাদের অপরাধ স্বীকার করেনি। Understanding the Bangladesh Jamaat e-Islami’s return – ORF অনুসারে, জামাত দীর্ঘদিন ধরে সত্য গোপন করে ইতিহাস পুনর্লিখনের চেষ্টা করছে।

জামাত-ই-ইসলামির ১৯৭১ সালের ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। আল-বদর বাহিনীর মাধ্যমে তারা মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, এবং নিরীহ সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছিল। ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামাতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বিচারের মাধ্যমে এই অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, যার ফলে অনেকেই মৃত্যুদণ্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছে।

জামাত তরুণ প্রজন্মকে প্রভাবিত করতে সামাজিক মাধ্যম, বিশেষ করে X ও টিকটক ব্যবহার করছে এবং #1971Truth হ্যাশট্যাগ ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কর্মসূচি পরিচালনা করছে এবং র‍্যালির মাধ্যমে ছাত্রদের কাছে তাদের বার্তা পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। এটি একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা, যা তাদের অতীতের অপরাধ ধামাচাপা দিতে এবং রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি করতে সাহায্য করছে।

জামাত-ই-ইসলামি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা চায়নি। বরং তারা বরাবরই এই ইস্যু এড়িয়ে চলেছে, তাই তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক, তা নিয়ে জাতীয়ভাবে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ক্ষমা চাওয়া এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য আনুষ্ঠানিক দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া জামাতকে রাজনীতিতে স্বাভাবিকীকরণ করা উচিত নয়।

এই ইতিহাস পুনর্লিখন বাংলাদেশের সেকুলার পরিচয়কে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সত্য রক্ষা করা জরুরি, কারণ এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা জরুরি। জামাত-ই-ইসলামি তার ১৯৭১ সালের ভূমিকা পুনর্লিখনের মাধ্যমে তাদের অতীতের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করছে এবং তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে। তাদের সামাজিক মাধ্যম প্রচার, ক্যাম্পাস কার্যক্রম, এবং ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টা বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। ক্ষমা চাওয়ার আগেই তাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের বৈধতা নিয়ে জাতীয় বিতর্ক থাকা উচিত।