কুইকপোস্ট নিউজ সম্পাদকীয় | ১৮ মার্চ ২০২৫

শেখ হাসিনার দশকব্যাপী শাসনকালে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) প্রায়ই সমালোচিত হয়েছে গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য। কিন্তু একটি গোপন ঘটনা প্রমাণ করে—এই সংস্থা সবসময় হাসিনার দাসত্ব করেনি। ২০১৮ সালের “মধ্যরাতের নির্বাচন”-এর আগে ও পরে, ভারতের বহির্বিশ্ব গোয়েন্দা সংস্থা (র) বাংলাদেশের এসএস৭ মোবাইল নেটওয়ার্কে প্রবেশের প্রস্তাব দেয়। হাসিনার কার্যালয় এতে সম্মতি দিলেও, ডিজিএফআই-এর দৃঢ় প্রতিরোধ জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় একটি সাহসী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এই প্রতিবেদন সেই গল্প উন্মোচন করে—কীভাবে ডিজিএফআই দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছিল।


ভারতের পরিকল্পনা

২০১৮ সালে, ভারতের র বাংলাদেশের এসএস৭ (সিগন্যালিং সিস্টেম নং ৭) নেটওয়ার্কে সংযোগ স্থাপনের প্রস্তাব দেয়—একটি প্রোটোকল যা কল, এসএমএস, এবং রোমিং পরিচালনা করে।

  • উদ্দেশ্য: ফোন নম্বর, অবস্থান, কলের সময়কাল—এমনকি পাকিস্তান-সংশ্লিষ্ট কলের মেটাডেটা সংগ্রহ।
  • হাসিনার সমর্থন: প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এতে অনুমোদন দেয়, প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে।

এই সংযোগ হলে ভারত বাংলাদেশের প্রতিটি কলের বিস্তারিত হাতে পেত—একটি সম্ভাব্য নিরাপত্তা বিপর্যয়।


সাবমেরিন কেবল ইন্টারসেপশন

ভারতের পরিকল্পনা এসএস৭-এ থামেনি—তারা বাংলাদেশে সাবমেরিন কেবল নজরদারি সিস্টেম চালুর প্রস্তাব দেয়।

  • কেবল সুবিধা: বাংলাদেশ এসএমডব্লিউ-৪ এবং এসএমডব্লিউ-৫ কেবলের অংশ—যা দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।
  • প্রস্তাব:
    • ভারত সরঞ্জাম এনে বাংলাদেশের ল্যান্ডিং স্টেশনে পরীক্ষা চালাতে চায়।
    • অথবা বাংলাদেশের দল ভারতে গিয়ে প্রযুক্তি দেখবে।
  • ফলাফল: এই সিস্টেম চালু হলে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কল ডেটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করত।

ডিজিএফআই-এর সাহসী প্রতিরোধ

হাসিনার কার্যালয় এবং এনএসআই-এর চাপ সত্ত্বেও, ডিজিএফআই অটল থাকে।

  • কারণ:
    • জাতীয় নিরাপত্তা: “এসএস৭-এ প্রবেশ জাতীয় স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক ছিল,” বলেন এক প্রাক্তন ডিজিএফআই কর্মকর্তা।
    • পাকিস্তান সমস্যা: ভারত পাকিস্তানের ডেটা চাইলেও, বাংলাদেশের নিজস্ব তথ্যও ফাঁস হতো।
    • স্বাধীনতা রক্ষা: বিদেশি শক্তির হাতে টেলিকম হস্তান্তর মেনে নেওয়া যায় না।
  • নেতৃত্ব: ঢাকার স্টেশন প্রধান প্রথমে আপত্তি জানান, পরে মহাপরিচালক তিনবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।

এই দৃঢ়তা বাংলাদেশের গোপনীয়তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় একটি জয় হিসেবে দাঁড়ায়।


হাসিনার চাপ ও ডিজিএফআই-এর উপর প্রভাব

প্রস্তাব বন্ধ করায় ডিজিএফআই-এর ভিতরে ঝড় ওঠে।

  • এনএসআই-এর ভূমিকা: প্রধান টিএম জোবায়ের, যিনি লন্ডনে ভারতের র প্রধান সামন্ত কুমার গোয়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছিলেন, ডিজিএফআই-এর ওপর চাপ সৃষ্টি করেন।
  • প্রতিশোধ: যারা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তাদের পদোন্নতি বন্ধ হয়, অনেকে গুরুত্বহীন পদে বদলি হন।
  • দ্বন্দ্ব: এটি হাসিনার সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং ডিজিএফআই-এর স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দেখায়।

পরিকল্পনা সফল হলে কী হতো?

যদি ডিজিএফআই না আটকাত:

  • গোপনীয়তা ধ্বংস: প্রতিটি নাগরিকের কলের বিস্তারিত ভারতের হাতে চলে যেত।
  • ভূ-রাজনীতি: পাকিস্তানের পাশাপাশি অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন হতো।
  • নিয়ন্ত্রণ হারানো: বাংলাদেশের টেলিকম অবকাঠামো ভারতের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের অংশ হয়ে যেত।
  • দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি: “মেটাডেটার বাইরেও কথোপকথন শোনার পথ খুলত,” বলেন এক সূত্র।

ডিজিএফআই-এর বিজয়

ডিজিএফআই-এর এই প্রতিরোধ বাংলাদেশের জন্য একটি গর্বের মুহূর্ত।

  • সাফল্য: জাতীয় স্বার্থ ও নাগরিক গোপনীয়তা রক্ষায় সাহসী পদক্ষেপ।
  • প্রশ্ন: তবে এটি হাসিনার শাসনের দুর্বলতাও তুলে ধরে—তার নিজের গোয়েন্দারা তার বিরোধিতা করেছে।
  • ২০২৪-এর প্রেক্ষাপট: ছাত্র আন্দোলনের পর হাসিনার পতনের পর এই ঘটনা নতুন আলো ফেলে—ডিজিএফআই কি জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, নাকি এটি ক্ষমতার খেলার অংশ?

২০১৮-এর এই প্রতিরোধ ডিজিএফআই-এর সাহসিকতার একটি উদাহরণ। হাসিনা ভারতের প্রস্তাবে সম্মতি দিলেও, ডিজিএফআই দেশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়েছে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বিদেশি প্রভাবের বিরুদ্ধে দৃঢ়তা জরুরি। বাংলাদেশের জনগণের জন্য এটি একটি পাঠ: সতর্ক থাকলে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারি


তথ্যসূত্র ও যাচাই: